Edit Content
Satarkul Branch
Uttara Branch (Junior Campus)
Uttara Branch (Senior Campus)

ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ সামাজিক উন্নয়ন ও সমানাধিকারের ভিত্তি স্থাপন করে

ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ সামাজিক উন্নয়ন ও সমানাধিকারের ভিত্তি স্থাপন করে

সব বাংলাদেশীকে গর্বিত করে বীরদর্পে ২০২২ সালে দেশে ফিরেছিল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। বছরের পর বছর টেবিল টেনিসে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়ে ২০০২-এ গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছেন জোবেরা রহমান লিনু। এসব অর্জন শুধু ক্রীড়াঙ্গনেই নয়, বরং সমাজের সব ক্ষেত্রেই নারীদের ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সঠিক সুযোগ পেলে নারীরা ক্রীড়াক্ষেত্রে কতটা উজ্জ্বল হতে পারে, তারই প্রমাণ হলো নারীদের এমন সব দুর্দান্ত সাফল্য।

‘মেয়েরা আবার খেলার কী বোঝে?’ এ ধরনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। এমন সব চিন্তাধারার কারণেই মেয়েদের খেলাধুলার দুনিয়ায় পা দেয়ার গতিটা অত্যন্ত ধীর। ‘যেসব কারণে বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাধার সম্মুখীন: একটি সামাজিক সমীক্ষা’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে যে খেলার দক্ষতা দিয়ে চাকরি পেয়ে পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার ইচ্ছা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় অংশ নেয়া নারীদের ৮৩ শতাংশই আসেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে চাকরি পান মাত্র ৩৪ শতাংশ। বাকিরা চাকরি বা আর্থিক কোনো নিশ্চয়তা না পাওয়ায় অনেকেই এ পথে আসতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন।

এসবের ফলে খেলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের জীবনের প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবার। সমাজের চোখরাঙানি, পোশাকের ধরন নিয়ে সমালোচনা, প্রতিবেশীদের তিরস্কার ও সামাজিক কুসংস্কারের ভয়ে অনেক অভিভাবক মেয়েদের ক্রীড়াক্ষেত্রে পাঠানোর কথা ভাবতেও পারেন না। এছাড়া বিবাহোত্তর কিছু বাধা আর অনুশাসন তো আছেই। রক্ষণশীল মনোভাব, মাতৃত্বকালীন ছুটিসংক্রান্ত জটিলতা অথবা ছোট বাচ্চা রেখে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া—এসবই একজন নারী খেলোয়াড়ের জন্য প্রতিবন্ধকতা।

উপরোক্ত গবেষণা অনুযায়ী, খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে নিয়ে নারীদের এগিয়ে না আসার কয়েকটি কারণ হিসেবে রয়েছে মৌলিক চাহিদার জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা, লিঙ্গবৈষম্য, পরিবারের বিরোধিতা, নারীদের বিশেষায়িত ক্লাব না থাকা, নিয়মিত টুর্নামেন্ট না হওয়া এবং অনুশীলনের জায়গার অভাব। অনেকে এটাও বলেন যে ক্রীড়াক্ষেত্রে নারী খেলোয়াড়দের যে পরিমাণ ত্যাগ, সেই অনুযায়ী যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা তারা পান না।

কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে যে নারীদের ক্ষমতায়নের বিভিন্ন উপায়ের মধ্যে খেলাধুলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং নেতৃত্বগুণের বিকাশে ভূমিকা রাখে। ক্রীড়াক্ষেত্রে আমাদের দেশের নারীদের বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে এবং তাদের সমর্থন করতে আমরা যে পদক্ষেপ নিতে পারি, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

তার আগে নারীর ক্ষমতায়নে ক্রীড়ার ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। নারীদের মাঝে নেতৃত্বগুণ বিকাশে খেলাধুলার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা তাদের কৌশলগত চিন্তাভাবনার ক্ষমতা বিকশিত করে। নেতৃত্বের সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে নারীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা সমাধান ও দল পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ গুণের বিকাশ ঘটাতে পারেন। এছাড়া খেলাধুলায় সফলতা অর্জন করার মাধ্যমে নারীরা সমাজে তাদের অবস্থান দৃঢ় করার পাশাপাশি অন্য নারীদেরও অনুপ্রাণিত করেন। সম্প্রতি ডিপিএস এসটিএস স্কুল ঢাকার মেয়েদের বাস্কেটবল টিম ‘ডিপিএস এসটিএস আন্তঃস্কুল বাস্কেটবল টুর্নামেন্টে (ডিআইবিটি)’ জয়ী হয়েছে। সেই দলের অধিনায়ক মুনাইজা আহমেদ জানিয়েছেন, বাস্কেটবলের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে তারা শুধু শারীরিকভাবেই উপকৃত হননি, পাশাপাশি সামাজিক পরিচিতিও লাভ করেছেন। মুনাইজা আহমেদের মতো অনেকেই খেলাধুলার ক্ষেত্রে অনেক মেয়েকে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন।

ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ দেশের অর্থনীতির জন্যও বহুমুখীভাবে কার্যকর। প্রথমত, নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ কোচ, প্রশিক্ষক, ফিজিওথেরাপিস্ট, অন্যান্য সাপোর্ট স্টাফসহ অনেক নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এছাড়া নারী ক্রীড়াবিদদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও সাফল্য দেশের জন্য গর্বের বিষয়। বিজ্ঞাপন ও মিডিয়া প্রচারের মাধ্যমে নারী ক্রীড়াবিদদের সাফল্য ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। তাদের স্পন্সরশিপ, ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট এবং বিভিন্ন প্রচারাভিযানের মাধ্যমে আয় বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়। একজন নারী খেলোয়াড় যিনি একজন কন্যা, বোন বা মা, তিনি তার নিজের পরিবারের প্রতিও যথেষ্ট সক্রিয় ও প্রেরণাদায়ক হয়ে থাকেন। এভাবেই একটা পরিবার থেকে সমাজ এবং ধীরে ধীরে গোটা দেশ অনুপ্রাণিত হয় খেলাধুলার প্রতি।

সব শেষে নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ সামাজিক উন্নয়ন ও সমানাধিকারের ভিত্তি স্থাপন করে, যা একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। নারীদের ক্ষমতায়ন ও তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হয়।

নারীদের খেলাধুলার প্রতি উৎসাহিত করতে হলে বিভিন্ন স্তরে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। প্রথমত, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নারীদের খেলাধুলার গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং কুসংস্কার ভাঙতে হবে। সফল নারী ক্রীড়াবিদদের সাফল্যের গল্প তুলে ধরা এবং তাদের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এ প্রচারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে।

নারীদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্কুল। তাই স্কুল ও কলেজে নারীদের জন্য খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি করতে সঠিক প্রশিক্ষণ ও সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত। তার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাধুলার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে দেশের অনেক স্কুল এখন ক্রীড়া শিক্ষা নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসছে এবং বিভিন্ন টুর্নামেন্টের মাধ্যমে স্কুলের মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করছে। শুধু দক্ষ বা অভিজ্ঞ কোচ হলেই হবে না একজন নারী খেলোয়াড়ের জন্য ভালো চিকিৎসাসেবা, পুষ্টিবিদ পরামর্শসেবা প্রদান, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের দিকেও গুরুত্ব দেয়া উচিত। নারীদের খেলাধুলার খরচ বহনের জন্য স্কলারশিপ, গ্রান্ট ও স্পন্সরশিপের ব্যবস্থা বাড়ানো যেতে পারে। নারীদের জন্য নিরাপদ খেলাধুলার পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন, যাতে তারা খেলাধুলায় অংশগ্রহণে কোনো রকম বাধার সম্মুখীন না হন। প্রশিক্ষণ ও কোচিং ব্যবস্থার উন্নয়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে নারীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও ক্যাম্পের আয়োজন করা এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ কোচ নিয়োগ করে সঠিক প্রশিক্ষণ দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশী নারী ক্রীড়াবিদদের বিশ্বজয়ী সাফল্য প্রমাণ করে যে সুযোগ ও সহায়তা পেলে নারীরা সব ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেন। তাই ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে সমাজের সবার সমর্থন অত্যন্ত জরুরি।

জেসমিন সুলতানা: হেড অব লোয়ার সেকেন্ডারি সেকশন,

গ্লেনরিচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (উত্তরা)

News Link: কর্মসংস্থান তৈরি ও কর্মমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া দরকার (bonikbarta.net)