Glenrich International School

Glenrich International School
কালের কণ্ঠ ১২ অক্টোবর, ২০২৩

ঢাকার আর দশটি সাধারণ পরিবারের মতোই মোহসিনার পরিবার। স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন। তাঁদের সন্তানের বয়স মাত্র তিন বছর পার হলো, অথচ তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই মা-বাবার। কোন স্কুলে দেবেন, কোথায় কী শিখবে, স্কুল কেমন হবে, শিক্ষক কেমন হবেন ইত্যাদি চিন্তায় তাঁদের ঘুম নেই কয়েক দিন। সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তার এই চিত্র আজকাল যেন খুব স্বাভাবিক।

বর্তমানে বেশির ভাগ পরিবারই শিশুর শিক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে। একটি শিশুর শিক্ষাগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় মায়ের গর্ভেই। আর এ কারণেই বেশির ভাগ ডাক্তার ওই সময় মায়েদের হাসিখুশি থাকতে বলেন, গান শুনতে বা অঙ্ক করাসহ সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার উপদেশ দেন।

মায়ের ভালো লাগার বিষয়গুলো সন্তানের মধ্যেও প্রবাহিত হয়। তবে মায়ের গর্ভে থাকাকালে প্রচ্ছন্ন শিক্ষা বা জিন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে যথেষ্ট নয়। শিশুটিকে পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত করতে হলে শৈশবেই পারিপার্শ্বিক শিক্ষা অর্জন করা জরুরি।

সাধারণত শিশুদের মস্তিষ্কের ৮০ শতাংশই প্রথম তিন বছরের মধ্যে গঠিত হয়ে যায়। এরপর তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত মস্তিষ্ক গঠিত হয়। এই সময়টি শিশুদের শিক্ষা ও বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাকি জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের ভিত্তি এ সময়েই গড়ে ওঠে। তাই এ সময়ে কী শিখবে আর কিভাবে শিখবে তার ওপরই নির্ভর করে শিশুটির সাফল্যের সম্ভাবনা। আর এ কারণেই শিশুর পূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞরা শৈশবের শুরুর (আর্লি চাইল্ডহুড) শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।

আর্লি চাইল্ডহুড শিক্ষা মূলত এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে শিশু খেলতে খেলতে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিখে নেয়। এ সময় শিশুদের প্রশ্ন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, জগতের সব কিছু সম্পর্কে জানার কৌতূহল তৈরি হয়। আর্লি চাইল্ডহুড শিক্ষা শিশুদের এই কৌতূহল মেটায়, জগেক নিজের মতো করে দেখার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। এই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিশুদের সামাজিক দক্ষতা গড়ে ওঠে, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে তারা। শিশুরা এ সময় বিভিন্ন রকম খেলার মধ্য দিয়ে কিভাবে নতুন নতুন জিনিস শিখতে হয়, তা চর্চা করে। ফলে বাকিদের চেয়ে খুব দ্রুত তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে। আর্লি চাইল্ডহুড শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশও ত্বরান্বিত হয়। সব দিক থেকে শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশে খুব কার্যকর হওয়ায় বিশ্বব্যাপী আর্লি চাইল্ডহুড শিক্ষার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

দেখা গেছে, যেসব শিশু আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন গ্রহণ করেছে, তারা বাকি শিশুদের চেয়ে সামাজিকভাবে বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছে। এই প্রগ্রামে শিশুরা নতুন বা অপরিচিত কারো সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে ও মিশবে, তা শিখছে। দলগতভাবে যে সমস্যাগুলোর সমাধান করা প্রয়োজন, তা সবার সঙ্গে একসঙ্গে খুঁজে বের করছে। যেকোনো পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সঙ্গে বেশ ছোটবেলা থেকেই পরিচিত হচ্ছে। আর এভাবেই তারা বাকি শিশুদের চেয়ে সামাজিকভাবে দক্ষ হয়ে উঠছে। এই সামাজিক দক্ষতা তাদের বাকি জীবনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এরপর আসে শারীরিক ও মানসিক দক্ষতার বিষয়টি। সমস্যার সমাধান ও সামাজিক দক্ষতা গড়ে ওঠার সঙ্গে মানসিক দক্ষতার কিছুটা সম্পর্ক রয়েছে। সমস্যা সমাধান করার মধ্য দিয়ে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। নতুন পরিবেশ বা পরিস্থিতি তাদের খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারে না, বরং সামাজিক দক্ষতায় বাকিদের চেয়ে এগিয়ে থাকার কারণে তারা খুব দ্রুত নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে।

শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে স্কুল বা শিক্ষকের পাশাপাশি পরিবারের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত তিনটি পক্ষ রয়েছে। একদিকে রয়েছে শিক্ষার্থী নিজে, অন্যদিকে রয়েছে ওই শিক্ষার্থীর পরিবার; আরেক দিকে রয়েছে তার স্কুল বা শিক্ষক। এই তিন পক্ষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে শিশুর বিকাশের পথ। শিশুর শিক্ষার প্রথম হাতেখড়ি হয় তার পরিবারেই। শিশুর যেকোনো অর্জনই পরিবারের সহায়তায় অভ্যাসে পরিণত হয়। আর একজন শিক্ষকের প্রধান কাজ হচ্ছে ওই শিশুটির কোথায় আগ্রহ রয়েছে, ভবিষ্যতে সে কোন ক্ষেত্রে ভালো করবে, তা আগে থেকে বের করতে পারা। পাশাপাশি শিক্ষার্থীর মেধা ও আগ্রহের ওপর ভিত্তি করে তাকে ওইদিকে পরিচালিত করা।

পরিবার ও শিক্ষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর দক্ষতা সম্পূর্ণ বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল ও উদ্ভাবনী করে তুলতে এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মেধা ও দক্ষতা বিকশিত করার মধ্য দিয়ে শিশুদের দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল ও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা। দেখা যায়, এই প্রগ্রামে শিশুরা নিজের কাজ নিজে করার অনুশীলন করছে। যেমন বলা যায়, তারা নিজের খাবার নিজে খাওয়ার চেষ্টা করছে বা নিজেই নিজের জুতা পরার চেষ্টা করছে। আর এতে খুব ছোটবেলায়ই তারা নিজের দায়িত্ব নিজেরা নেওয়া শিখছে। আবার দেখা যায়, তারা বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবার খাচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতা। খেলতে খেলতে পড়ছে, নতুন নতুন বিষয় শিখছে শিশুরা, যা তাদের সংবেদনশীল ও উদ্ভাবনী হয়ে গড়ে উঠতে ভূমিকা রাখছে।

অনাগত দিনে শিশুর বিকশিত হওয়ার ভিত্তি গড়ে ওঠে শৈশবেই। তাই শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিশুর যথার্থ পরিবেশে শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের গুরুত্বসহ উপলব্ধি করতে হবে। ছোটবেলায়ই সন্তানকে যথার্থ শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত করানো গেলে মোহসিনার মতো অনেকেই নিশ্চিন্ত হতে পারবেন।

 লেখক : হেড অব জুনিয়র স্কুল, গ্লেনরিচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

Source: শৈশবের শিক্ষায় বিকশিত হোক সাফল্যের সম্ভাবনা (kalerkantho.com)